মানিকগঞ্জের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে তেওতা জমিদার বাড়ি ঐতিহ্য ও দৃষ্টি নান্দনিকতার দিক দিয়ে অনন্য। এর অবস্থান মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের তেওতা গ্রামে।
জানা যায়, পঞ্চানন সেন নামে এক ব্যক্তি ৭.৩৮ একর জমি নিয়ে ১৭ শো শতকে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রাসাদের পূর্বদিকে রয়েছে লালদিঘী অন্দরমহল। এই প্রাসাদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে টালির তৈরি বিশাল আকৃতির কাচারিঘর। পাশে আছে ৭৫ ফুট উচ্চতার নবরত্ন মঠ। নবরত্ন মঠের পশ্চিম দিকে রয়েছে শান বাঁধানো পুকুরঘাট। জমিদারদের উপাসনালয় হিসেবে লালদীঘি ময়দানের মাঝে রয়েছে একটি নাট মন্দির। ছোট বড় মিলিয়ে প্রাসাদটিতে মোট ৫৫টি কক্ষ শোভা পাচ্ছে। পঞ্চানন সেন প্রাসাদটি নির্মাণ করলেও পরবর্তীতে হেমশংকর ও জয়শংকর নামে দুই ব্যক্তি এখানে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ভারত বিভক্তির পর তারা দেশ ত্যাগ করলে প্রাসাদটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর প্রাসাদটির দেখাশোনা ও দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় চলে যায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পত্নী প্রমীলার পৈতৃক ভিটা এই প্রাসাদ সংলগ্ন হওয়ায় এই জমিদার বাড়ি ঘিরে কবি এবং কবি পত্নীর বহু স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার দর্শনার্থী এই জমিদার বাড়ি ভ্রমন করতে আসেন। কথিত আছে, বিদ্রোহী কবি তার সাহিত্য ভান্ডার পরিপূর্ণ করতে এবং প্রচারের স্বার্থে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার বাড়ির ব্যারিস্টার কিরণ শঙ্কর রায়ের বাড়িতে একাধিকবার যাতায়াত করেছেন। নজরুলের সাহিত্য চর্চার প্রেরণা এবং প্রেমের উৎস কবির সহধর্মিণী আশালতা সেনগুপ্ত দোলন বা দুলি ছিলেন তেওতা গ্রামের বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত এবং তার স্ত্রী গিরিবালা দেবীর একমাত্র সন্তান। আশালতা সেনগুপ্ত ১৯০৮ সালে তেওতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তার বাবা বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরায় নায়েব পদে চাকরি করতেন। কাকা ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ত্রিপুরায় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর ছিলেন।
ইন্দ্র কুমার চাকরি সূত্রে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে বাড়ি-ঘর করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করেন। তবে বসন্ত কুমারের পরিবার তেওতার বাড়িতে বসবাস করতেন। হঠাৎ বসন্ত কুমারের মৃত্যুতে আশালতার মা অসহায় হয়ে পড়লে তার কাকা ইন্দ্রকুমার আশালতা ও তার মা গিরিবালা দেবীকে কুমিল্লার কান্দির পাড়ে নিয়ে যান। কাজী নজরুল ইসলাম তার বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় বেড়াতে আসলে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে তার সঙ্গে আশালতার পরিচয় হয়। নজরুল আশালতার টানে পাঁচবার কুমিল্লায় আসেন এবং বিয়ের আগে তেওতায় আসেন তিনবার। শেষবার জেল থেকে মুক্ত হয়ে কুমিল্লায় আসলে আশালতা ও নজরুলের প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এক পর্যায়ে নজরুল কুমিল্লা ছেড়ে কলকাতায় চলে যান।
সামাজিক চাপে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আশালতার মা গিরিবালা দেবী আশালতাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯২৪ সালে গিরিবালা দেবীর ইচ্ছায় নজরুল ও আশালতার বিয়ে সম্পন্ন হয়। সবকিছু মিলিয়ে তেওতা জমিদার বাড়িটি ঐতিহাসিক পরিচয় বহন করে কালের সাক্ষী হয়ে অযত্ন অবহেলায় ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার বাড়ির পূর্বপাশে দৃষ্টিনন্দন ইউনিয়ন ভূমি অফিস, পূর্ব দক্ষিণে তেওতা একাডেমি, পশ্চিম দক্ষিণে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কৃষি পরামর্শ অফিস, ব্যাংক এশিয়াসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জমিদার বাড়ির সামান্য পশ্চিমে রয়েছে তেওতা বাজার সংলগ্ন নয়নাভিরাম যমুনা নদী।
তেওতা জমিদার বাড়ি ছাড়াও মানিকগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে শিব সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, বালিয়াটি জমিদার বাড়ি, বালিয়াটি ঈশ্বর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীশ্রী আনন্দময়ী কালিবাড়ি মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম, ভাষাশহীদ রফিক গ্রন্থাগার ও স্মৃতি যাদুঘর, গৌরাঙ্গ মঠ ও মত্তের মঠ উল্লেখযোগ্য।
আজ বেশ কয়েক বছর যাবত নজরুল প্রমিলার স্মৃতি বিজড়িত স্থানে তাদের জন্ম ও মৃত্যু তিথীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে রয়েছে, নজরুল প্রমিলা ইনস্টিটিউট, নজরুল-প্রমিলা পরিষদ, নজরুল-প্রমিলা সাহিত্য সংসদ, প্রমিলা নজরুল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ইত্যাদি নামে বিভিন্ন সংগঠন।
তেওতা জমিদার বাড়িতে ঘুরতে আসা পর্যটক আব্দুল হালিম, জলি আক্তার, মুন্নাফ পাঠান, রিদিতা ইসলাম, অঞ্জলী রায়সহ বেশ কয়েকজন ভ্রমণ পিপাসু জানান, তেওতা জমিদার বাড়ি বেড়াতে এসে অনেক আনন্দ উপভোগ করেছেন। এখানকার অনেক কিছু দেখে তাদের অনেক ভালো লেগেছে। কিন্তু বাড়িটি সংস্কার করা হলে অনেক বেশি ভালো লাগতো। বাড়িটি সংস্কার করা বড় বেশি প্রয়োজন।
শিবালয় প্রেসক্লাবের সভাপতি বাবুল আকতার মঞ্জুর বলেন, কবি নজরুল ও তার স্ত্রী প্রমিলার স্মৃতিজড়িত তেওতায় সরকারি উদ্যোগে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন ও ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে নজরুল সাহিত্য যেমন বিকশিত হবে তেমনি এ স্থানটি আরো আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠবে।
তেওতা ইউনিয়নের নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন জানান, তেওতা জমিদার বাড়ির কারনে আমাদের তেওতা গ্রামের পরিচিতি বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রমীলা দেবীর পৈতৃক ভিটা এবং জমিদার বাড়ির কারনে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম আমাদের এই গ্রামে বেশ কয়েকবার এসেছেন। প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী এখানে আসেন। তবে কালের বিবর্তে এবং সংস্কারের অভাবে বাড়িটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। বর্তমানে এই জমিদার বাড়ির দেখাশোনা ও সংস্কার ভার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ওপর ন্যাস্ত রয়েছে। আমি মনে করি বাড়িটি সংস্কারের বিষয়ে সরকারের আরো বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন।
ঢাকা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখি রায় জানান, সারা দেশে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় বেশকিছু জরাজীর্ণ নিদর্শন রয়েছে। অতি জরাজীর্ণ নিদর্শনগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার করা হচ্ছে। তেওতা জমিদার বাড়ির সংস্কার কাজের জন্য বরাদ্দের আবেদন দেয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী বছর ওই বাড়ির সংস্কার কাজে আমরা হাত দিতে পারবো।
শিবালয় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহবুবুল ইসলাম জানান, শিবালয়ে এরকম একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন থাকা মানে শিবালয়বাসীর জন্য গর্বের বিষয়। পুরনো এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো আমাদের ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার অতীব জরুরি।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল লতিফ দৈনিক ভোরের কাগজকে জানান, এই জমিদার বাড়িটি সংস্কারের জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করছি, অতি তাড়াতাড়ি প্রাসাদটির সংস্কার কাজ শুরু হবে এবং জমিদার বাড়িটি পুনরায় তার হারানো জৌলস ফিরে পাবে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস